অখিল বিমানে


#

গৌহাটি র উদ্দেশ্যে বিমান আকাশে উড়ান দিলে সিট এ পিঠ এলিয়ে চোখ বুজলাম। গৌহাটি যাওয়া হবে কথা হলেই একটা ছবি মাথায় ঘুরে ফিরে আসে, নানা কাজে থাকি বলে ছবিটা আবছা থেকে যায়, আজ যেন খুব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, একটা ছোট মেয়েকে মা খাইয়ে দিচ্ছে, পাশে তার চেয়ে বড়ো বোন নিজে খাচ্ছে বটে, তবে চোখ এবং মন পুরোপুরি শুকতারা র টারজান এর পাতায়। মা বকছে, ঠিকমতো না খাবার জন্য, মেয়ের কানে সেসব ঢুকছে না। এমন সময় বাবা এসে ঘোষণা করলো এবার গরমের ছুটি তে গৌহাটি যাবো। মেয়ে বেড়াতে ভালোবাসলেও গৌহাটি নিয়ে বিশেষ উত্তেজনা বোধ করলো না, তার চেয়ে আফ্রিকার জঙ্গলের মানস ভ্রমণ বেশি লোভনীয়। তারপর বাবা বললো, অফিস থেকে প্লেনের ভাড়া দেবে, প্লেনে যাওয়া হবে। সত্যি! এবার দুই বোন এবং মা সবার চোখ গোল্লা। এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝে গেছেন ওই বড়ো মেয়েটি আমি, যে কি না সবে জানুয়ারী মাসে ক্লাস ফাইভে উঠেছে আর গরমের ছুটিতে বেড়াতে যাবার কথা শুনছে

তখন পর্যন্ত ধারণা ছিল বেড়ানো মানে কু ঝিক ঝিক ট্রেন।প্লেন অবশ্য আমরা শুধু যে আকাশে উড়তে দেখেছি তা নয়, দমদম বিমান বন্দরে আগে গেছি মায়ের সঙ্গে বড়মাসীকে আনতে। তখন বাড়ির লোক ভেতরে ঢুকে প্লেন নামছে, দেখতে পেতো।  বড়মাসী আসতো বিদেশ থেকে।  সঙ্গে যা যা নিয়ে আসতো, সবই অন্য রকম। তা সে খেলনা হোক, বা জামা কাপড়, সাবান, লজেন্স,যাই হোক।এমন কি বিদেশের গন্ধটা পর্যন্ত আলাদা।সেই প্লেনে যে  আমরাও  চড়তে পারি, এটাই জানা ছিল না।  তারপর সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে যা হয় আর কি, দিন কয়েক ধরে প্লেনের আলোচনা।সে আলোচনায় প্লেন আবিষ্কার থেকে প্লেন একসিডেন্ট, প্লেন হাইজ্যাক - কি না ছিল।অবশেষে একদিন বাবা নিয়ে এলো প্লেনের টিকিট। ওপরে মহারাজার মিষ্টি ছবি।সঙ্গে প্রশ্নাবলী,  

তাহলে প্লেন কে আবিষ্কার করেছিল?

- রাইট ভ্রাতৃদ্বয়

প্লেন তৈরী করতে কি মেটাল ব্যবহার হয়?

-স্টেইনলেস স্টিল? এটা পুরো আন্দাজে

- উহু, অ্যালুমিনিয়াম। এই যে প্লেন এ মহারাজা র ছবি, একে কি বলে?

-লোগো

কার আঁকা জানিস?

-না

উমেশ রাও। কাকে দেখে আঁকা?

-জানি না

সৈয়দ ওয়াজিদ আলী, মনে থাকবে?

-হ্যা--- লম্বা ঘাড় নাড়ি।

যত যাবার দিন এগিয়ে আসে তত লোকের উপদেশ বাড়ে। বাবা মা র কাছাকাছি থাকবে, দৌড় ঝাঁপ করবে না, (এগুলো শুধু আমার উদ্দেশ্যে বলা, বোন এমনিতেই মা কে আঁকড়ে থাকে, অচেনা পরিবেশে তো আরো),  এয়ার হোস্টেস ট্রে ভর্তি লজেন্স দেবে, একটার বেশি নেবে না, তা হলে লোকে হ্যাংলা বলবে (ছোট বাচ্চার ওপর এটা কি ধরণের অত্যাচার!), কানে তুলো গুঁজে রাখবে, ইত্যাদি।

নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে সবচেয়ে সুন্দর জামা জুতো পরে দমদম পৌঁছানো হলো।আমি বাবা র সঙ্গে। বাবার নির্দেশ মতো নিজেদের লাগেজে সুন্দর করে নাম লিখে আটকানো হল। লাগেজ ট্যাগ লাগানোর কায়দা তিনবারেও শিখতে না পারায় বাবার বকুনি খেলাম।তারপর যথা সময়ে সিঁড়ি দিয়ে প্লেন এ চড়া।এয়ার হোস্টেস এর ট্রে থেকে একটা লজেন্স ই নিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি নিজে থেকেই মুঠো ভরে লজেন্স দিলেন।আর পেয়েছিলাম ফ্রেশনার। সেটা আমার কাছে বেশি আকর্ষণীয় এবং লোভনীয় লেগেছিলো। 

সেই প্রথম বিমান ভ্রমণ বড়ো মধুর। এখন ছোটবেলার অবাক চোখ নেই, বিমান ভ্রমণ ও মহারাজা চলে যাবার পর থেকে আভিজাত্য হারিয়েছে।সে এখন বড়োই সাধারণ। সত্যি বলতে কি এখন প্লেনে চোখ বুজে বসে থাকি, আকাশ ও দেখি না প্লেনের পাখনা র খোলা পড়া ও দেখি না।এখন লাগেজে ট্যাগ লাগাতে হয় না, কানে তুলো গুঁজতে হয় না, ফ্রেশনার বা লজেন্স নিয়ে এয়ার হোস্টেস আসে না। ঝ্যালজেলে সালোয়ার কামিজ পরে প্লেনে চড়ি। কখন ছাড়বে, কখন পৌঁছাবে, কিছু ঠিক নেই। বাবা র হাত ছেড়ে একা একা অনায়াসে প্লেনে এ চেপে বসি,  সহযাত্রী র সঙ্গে ঠেলাঠেলি করে মালপত্র রাখি আর ভাবি, বাবা আমাকে এই চেহারায় দেখলে কি ভাবতো।  

রাইট ভাই রা প্লেন আবিষ্কার করতে পারেন, কিন্তু নীল আকাশে ওড়ার  চিন্তা প্রথম এসেছিলো একজন বাবার মাথায়, যার নাম ডেডেলাস, একজন বিখ্যাত গ্রিক স্থপতি।

ডেডেলাস আর তার ছেলে ইকারাস ক্রিট দ্বীপে রাজবন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিলেন। বন্দিদশা অসহ্য হয়ে ওঠায় ডেডেলাস পালানোর উপায় খুঁজতে লাগলেন।ক্রিট দ্বীপের চারিপাশে সমুদ্র, সর্বক্ষণ সেখানে পাহারা। ডেডেলাস ভাবলেন, যদি আকাশ পথে পালানো যায়। প্রতিভাবান স্থপতি তৈরী করলেন বিশাল দুটি ডানা, যাতে পালক লাগানো হলো মোম দিয়ে। আর দড়ি দিয়ে আটকানো হলো শরীরের সঙ্গে। ঠিক যেভাবে পাখি ওড়ে, প্রায় সেই জিনিস ই তৈরী হলো বাবা আর ছেলের জন্য।

ডেডেলাস ছেলে কে শেখালেন কি করে উড়তে হয়।তারপর বললেন, ওড়ার সময় খুব নিচু দিয়ে উড়বে না, তাহলে সমুদ্রের জোলো বাতাস টেনে পাখা ভারী হয়ে যাবে, আবার খুব উঁচু দিয়েও উড়বে না, তা হলে সূর্যের তাপে মোম গলে যাবে।  

ডেডেলাস বুঝেছিলেন এই যাত্রা হতে চলেছে, একই সঙ্গে অভূতপূর্ব ও বিপজ্জনক।তবু বন্দি দশা থেকে মুক্তির হাতছানি তাকে এই পথ বেছে নিতেই উদ্বুদ্ধ করলো।

ভোরবেলা সকলের অলক্ষ্যে যাত্রা শুরু করলো বাবা আর ছেলে। ইকারাস প্রথম দিকে বাধ্য ছেলের মতো বাবাকে অনুসরণ করলেও ওড়ার আনন্দে, মুক্তির আনন্দে ভুলে গেলো বাবার সাবধান করে দেওয়া সব নির্দেশ।  অনেক উঁচু তে উঠে গেলো সে।বাবার চিৎকার, নিষেধ কিছুই কানে গেলো না তার।

ডেডেলাস আঁচ করলেন ছেলের বিপদ আসন্ন।তিনিও উঠে গেলেন অনেক উঁচুতে, নিজের দুই ডানা দিয়ে ঢেকে দিলেন ছেলেকে।

কিন্তু ততক্ষনে বিপদ যা হবার হয়ে গেছে।ইকারাসের ডানার মোম গলে যাওয়ায় সে নিচে পড়তে শুরু করলো, সেই সঙ্গে ডেডেলাস ও এগিয়ে চললেন তার অন্তিম পরিণতির পথে।

এতক্ষণে আমাদের বিমান ও গৌহাটিতে অবতরণ করবে, এই মর্মে  ঘোষণা শুরু হয়েছে। চোখ খুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, যুগে যুগে সব বাবারাই তাদের সুদীর্ঘ ডানায় ঢেকে রেখেছেন তাদের সন্তানদের।  ডেডেলাসে র আর্তনাদের সঙ্গে কিভাবে যেন মিলে যায় বাবরের প্রার্থনা, "ধ্বংস করে দাও আমাকে হে ঈশ্বর, আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।"আকাশ জুড়ে এক অখিল বিমানে যেন ভেসে বেড়ায় বিশ্বের সব পিতার সন্তানস্নেহের জয়গান।